সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইন

সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইন দুইটি ভিন্ন বিষয়। এবং এর উৎপত্তি ও ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে। সাংবিধানিক আইন হলো সেসব কর্তৃত্বপূর্ণ নিয়মাবলী যেগুলো সার্বভৌম কর্তৃত্ব এবং
সাংবিধানিক-আইন-ও-প্রশাসনিক-আইন
তার অধীনস্থদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে। অপরদিকে গণভিত্তিক আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হলো প্রশাসনিক আইন। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।

পেজ সূচিপত্রঃ সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইন

সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইন

সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইন সম্পর্কে আলাদা ভাবে জেনে নেওয়া যাক। প্রথমে জেনে নেওয়া যাক সাংবিধানিক আইন সম্পর্কে। সাধারণভাবে কোন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সংবিধান বা শাসনতন্ত্রে যে সকল আইনের বর্ণনা থাকে সেগুলোকে সাংবিধানিক আইন বলে। সাংবিধানিক আইনের অপর নাম শাসনতান্ত্রিক আইন। রাষ্ট্রের মৌলিক গঠন ও শাসন পদ্ধতি সম্পর্কে সকল প্রকার আইনই সাংবিধানিক আইনের অন্তর্ভুক্ত।

সাংবিধানিক আইনকে অনেক ক্ষেত্রে মৌলিক আইন বা গঠন পদ্ধতিমূলক আইন ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিধানাবলী, সরকার ও বিচার বিভাগের গঠন, ক্ষমতা, পরস্পরের সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়াবলী নির্ধারণ করা হয়। সাংবিধানিক আইনের অন্যতম লক্ষ্য হলো রাষ্ট্র ও সরকারের সাথে নাগরিকদের সম্বন্ধ নির্ধারণ করা।
অপরদিকে প্রশাসনিক আইনের সর্বজস্বীকৃত সংজ্ঞা দুর্লভ। তবে প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি কর্তৃপক্ষের সংগঠন, ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কার্যাবলী ইত্যাদি প্রশাসনিক আইনের মাধ্যমে নির্দেশিত হয়। এসব কর্তৃপক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের আন্তঃসম্পর্ক, নাগরিকদের সঙ্গে সম্পর্ক এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক প্রশাসনিক আইনের আওতাভুক্ত।

প্রশাসনিক আইন ও সাংবিধানিক আইন সম্পর্কে কোন সংজ্ঞা প্রদান বা তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নির্দেশ করার বিষয়টি বিভিন্ন লেখকের স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গি সাপেক্ষ। স্যার আইভর জেনিংস প্রশাসনিক আইনের সংখ্যায় বলেন, যেখান থেকে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের কাঠামো, ক্ষমতাও দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয় তাকেই প্রশাসন সংক্রান্ত আইন বা প্রশাসনিক আইন বলে।

সংবিধানে নির্ধারিত বিধান অনুসারে প্রশাসনের কাঠামো এবং এর কর্তব্য দায়িত্ব স্থির করা হয় বলে জেনিংস এর উপরে উক্ত সংখ্যাটি প্রশাসনিক আইনের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। ডেভিড বলেন, প্রশাসনিক আইনকে এভাবে চিহ্নিত করা যায় যে প্রশাসনিক আইন হলো আইনের সেই অংশ যা লোক প্রশাসনের সংগঠন ও কর্তব্য নির্ধারণ কাজে ব্যাপৃত। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র ও নাগরিকের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সম্পর্ক স্থির করা হয়।

সাংবিধানিক আইনের প্রকৃতি ও পরিধি

অনেক আইন বিশারদের মতে, সাংবিধানিক আইনের মৌল নীতি এবং আইনসিদ্ধ পদ্ধতির মৌল নীতি শেষ পর্যন্ত অবশ্যই প্রথাগত প্রকৃতির হবে। এই নীতিটি লিখিত সংবিধানের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। সাধারণত মৌলিক প্রথাগত রীতিনীতি কে আইনের সাধারণ প্রথাগত রীতিনীতি হতে স্বতন্ত্র বিবেচনা করা হয়। এর কারণ এই যে, মৌলিক প্রথাগত রীতিনীতি এত অনমনীয় যে এগুলো পরিবর্তনের জন্য আইনসভা বা বিচার বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুসারে সংশোধনী বা পরিবর্তন আনায়ন করা যায় না।

কিন্তু এ ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করে সাধারণ প্রধানত রীতিনীতি সমূহকে সংশোধন পরিবর্তন এমনকি রদও করা যায়। আবার মৌলিক নিয়ম-কানুন সমূহকে নৈতিক নিয়ম-কানুনের ন্যায় সম প্রকৃতির হিসেবে গণ্য করা হয় না। সাধারণ আইন ব্যতিরেকে সংবিধান ও রাষ্ট্র চলতে পারে কিন্তু রাষ্ট্র ও সংবিধান ছাড়া আইন কোনোভাবে কার্যকর থাকতে পারে না। এভাবে সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইন এর মধ্যে সাংবিধানিক আইনের প্রকৃতি ও পরিধি অনুসন্ধান করলে আমাদের সম্মুখে যে বিষয়গুলো দেখা যায় সেগুলো হলো-
  • সাংবিধানিক আইন রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম ক্ষমতার বন্টন বিধি নির্ধারণ করে।
  • সাংবিধানিক আইনের নির্দেশনা মান্য করার মাধ্যমে সরকারি ক্ষমতা কোন উদ্দেশ্যে এবং কোন কোন বিভাগের দ্বারা পরিচালিত হয় তা নির্ধারণ করা যায়।
  • সাংবিধানিক আইনই স্থির করে সরকারি বিভাগ সমূহের মধ্যে কি সম্বন্ধ থাকা উচিত।
  • সাংবিধানিক আইন বিবর্তনশীল, এটা স্থায়ী কোন সত্তা নয়। সামাজিক অবস্থা সাথে সাথে সংবিধানও পরিবর্তন হয় এবং অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য আনয়ন করে। সংবিধানেই উল্লেখ থাকে যে কি উপায়ে সাংবিধানিক আইন পরিবর্তন বা পরিবর্তন করতে হবে।
  • নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণের পদ্ধতি সমূহও সংবিধান বিবৃত করে অর্থাৎ নাগরিকগণের মৌলিক অধিকার বর্ণনা ও এগুলোর সংরক্ষণ সাংবিধানিক আইনের এক মৌলিক বিষয়।
  • সাংবিধানিক আইন সরকারের গঠন কাঠামো নির্ধারণ করে।
  • সরকারের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যাবলী নির্ধারণের সাথে সাথে জনসাধারণের সাথে উক্ত কার্যাবলীর পারস্পরিক সম্পর্ক এ আইনে বর্ণিত থাকে।
  • সরকারের কার্যাবলী এবং দায়িত্ব-কর্তব্য ও সাংবিধানিক আইনের দ্বারাই নির্ধারিত হয়।
পরিশেষে বলা যায়, বাস্তবতা ও প্রয়োজনের জন্য সাংবিধানিক আইন বিলুপ্ত হতে পারে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মৌলিক ও ব্যাপক বিস্তৃত নিয়ম-কানুন, প্রধান আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান তথা আইনসভার গঠন ও কার্যপ্রণালী বিধি, সুপ্রিম কোর্টের গঠন, কার্যাবলী এবং

বিচারপতিগণের ক্ষমতা সংক্রান্ত নিয়মাবলী ইত্যাদি সাংবিধানিক আইনের আওতাভুক্ত। কোন কোন দেশের সাংবিধানিক আইনকে অন্যান্য বিধিবদ্ধ আইন থেকে পৃথকভাবে সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়,যা আইন সভার সাধারণ আইন পরিবর্তনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা যায় না।

সাংবিধানিক আইনের উৎস ও সংবিধানের সম্পর্ক

সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইনের মধ্যে সাংবিধানিক আইন প্রধানত সংবিধান থেকেই আগত বিধায়, বিভিন্ন দেশের সংবিধানে বিভিন্ন রকমভেদ দেখা যায়। বৈশিষ্ট্যগত ভিন্নতার কারণ সাংবিধানিক আইনের উৎস নির্ধারণের মূল ভূমিকা রাখে। লিখিত সংবিধান কে সাংবিধানিক আইনের সুনির্দিষ্ট উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ লিখিত সংবিধান সাধারণত অনমনীয় ও দুস্পরিবর্তনীয় হয়ে থাকে।

এরূপ সাংবিধানিক আইনের উৎস রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা তথা বিধানসভা কর্তৃক বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকে। অলিখিত সংবিধানের প্রকৃতি সাধারণত নমনীয় ও সুপরিবর্তনীয়। তাই অলিখিত সংবিধানকে সংবিধানিক আইনের সুনির্দিষ্ট উৎস হিসেবে গণ্য করা হয় না। দীর্ঘদিন যাবত পালিত প্রথা, বিচার আদালতের সিদ্ধান্ত, নজীর, বিশেষ অধিকার সমূহ ইত্যাদি
সাংবিধানিক-আইন-ও-প্রশাসনিক-আইন
অলিখিত সংবিধানের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক আইনের উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়। সংবিধান এবং সংবিধানিক আইন শব্দ দুটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সার্বিকভাবে বলা যায় সাংবিধানিক আইনের উৎস হলো সংবিধান, তবুও সাংবিধানিক আইনের রূপরেখার মধ্যেই সংবিধান প্রণীত হয়। তাই সাংবিধানিক আইনের সাথে সংবিধানের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।

এভাবে দেখা যায় রাষ্ট্র পরিচালনার বিধি-বিধান বা রাষ্ট্রপরিচালনার একান্তভাবে মৌলিক নিয়ম কানুন সমূহ সংবিধানে বর্ণিত থাকে। কিন্তু সাংবিধানিক আইন হলো সংবিধান সংক্রান্ত এরূপ আইন, যার মাধ্যমে সরকার গঠন এবং সরকারের প্রধান অঙ্গসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারিত হয়।

সাংবিধানিক আইন একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন

সংবিধান হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক, মৌলনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নকশা। রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার সার্বিক অবকাঠামো রূপরেখা যেমন সরকারের গঠন পদ্ধতি, শাসক শাসিতের সম্পর্ক ইত্যাদি সংবিধানের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়। এ প্রসঙ্গে আইন বিশারদ ব্রাইস উক্তি করেন যে, সংবিধান ছাড়া কোন রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব নয়।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তো বটেই এমনকি একনায়কতন্ত্রে ও সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। অর্থাৎ সংবিধানের মাধ্যমে সরকারের গঠন প্রণালী এবং অঙ্গসমূহ ও বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাই রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন নীতি পদ্ধতি, জনসাধারণের অধিকার এর অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হয় বিধায়,
সংবিধানের দ্বারাই দেশের শাসন ব্যবস্থার রূপ ও চরিত্র নির্মিত হয়ে থাকে। সংবিধান এমন একটি আইনগত ধারণা, যার অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু হলো রীতিনীতি, ঐতিহ্য, প্রথা ইত্যাদি। সংবিধান রাষ্ট্রের মৌলিক আইন হিসেবে গণ্য করার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌম ক্ষমতার বন্টন বিধিরসংবিধানের বিধৃত করা থাকে। রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য,

প্রয়োজনীয় যেসব আইন প্রণয়ন করা দরকার তার সবই সংবিধানের আওতায় করে একে রাষ্ট্র পরিচালনার চাবিকাঠিতে পরিণত করা হয়। এজন্য কোন রাষ্ট্রে সংবিধান পরিপন্থী কোন আইন প্রদান করা যায় না। কোনক্রমে করা হলেও এর প্রতিকারার্থ প্রয়োজনীয় বিধি পদ্ধতি সংবিধানে খুঁজে নিতে হয়। সুতরাং এসব কারণে সংবিধানকে দেশের সর্বোচ্চ আইন বলা হয়ে থাকে।

প্রশাসনিক আইনের ব্যাপ্তি ও আওতা 

সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইনে এর আলোচনায় ব্যাপক অর্থে প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল আইন প্রশাসনিক আইন হিসেবে গণ্য হয়। কোন রাষ্ট্রের অন্যতম উপাদান হিসেবে জ্ঞাত সরকার যতটা প্রাচীন সে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক আইনের ইতিহাস ও ততোটাই প্রাচীন। আইনের বিশেষ শাখা হিসেবে প্রশাসনিক আইন উনবিংশ শতাব্দীর পর্যন্ত স্বীকৃতি লাভ করতে পারিনি। এমনকি এমনও দেখা গেছে যে বিংশ শতাব্দীতেও এংলো আমেরিকান দেশসমূহে উক্ত স্বীকৃতি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ হয়নি।

অবশ্য প্রশাসনিক আইন সম্পর্কে লেখকদের শ্রেণীবিন্যাসের অক্ষমতাকে প্রশাসনিক আইনের স্বীকৃতি লাভে ব্যর্থতার জন্য দায়ী করা হয়। ডাইসীর মতে, ইংল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক আইন প্রায় অপরিচিত ছিল। ১৯২০ সালে আমেরিকার আইন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসনিক আইনের কোর্স চালুর মাধ্যমে বর্তমানে পরিচিতির উন্নতি করতে শুরু করেছে। এখন আমেরিকার বার অ্যাসোসিয়েশন এই বিষয়ে একটি কমিটি সক্রিয় রেখেছে।এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আইনের অঙ্গনে,
প্রশাসনিক আইনের গুরুত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও এর ব্যাপ্তি ও প্রসার লক্ষণীয়। ইংল্যান্ডের রাষ্ট্র কর্তৃক সমাজ সেবামূলক কাজকর্মের পরিধি বৃদ্ধির সাথে যুগপৎ প্রশাসনিক আইনের বিস্তার অগ্রসর। বিভিন্ন দেশের সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যত বাড়ছে প্রশাসনিক আইনের ব্যাপ্তি ও আওতাও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রশাসনিক আইনের আওতা দেখতে হলে প্রশাসনিক শব্দটি বুঝতে হবে।প্রশাসনিক শব্দটি কোন রাষ্ট্রের প্রশাসনিক সংস্থা সমূহ কে সুনির্দিষ্ট  ভাবে নির্দিষ্ট দেয়।

এই শব্দটি দ্বারা বেসরকারিভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ের সংগঠন সমূহকে ও ব্যক্তি ভিত্তিক প্রশাসনকে নির্দেশ করে না। একইভাবে সমুদয় সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনিক আইনের আওতাভুক্ত নয়। যে সকল রাষ্ট্রীয় সংস্থা প্রতিষ্ঠানের বিধি প্রণয়ন বা বিচারপূর্বক রায় দানের ক্ষমতা রয়েছে বা উভয় ক্ষমতায় রয়েছে সে সকল সংস্থায় প্রশাসনিক আইনের আওতাভুক্ত হয়েছে।আলোচ্য ক্ষেত্রে বিধি বলতে রাষ্ট্রীয় সংস্থা সমূহের কর্মচারী পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রণীত বিধিসমূহ কে বুঝানো হয়েছে। রায় বলতে বিচারপূর্বক সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য প্রণীত বিধি সমূহের বাস্তবায়ন কে নির্দেশ করা হয়েছে।

প্রশাসনিক আইনের বিবেচ্য বিষয়

সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইন এর আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে যে মৌলিক প্রশ্নগুলি প্রশাসনিক আইনের আলোচনা করা হয় তাহলো-
  • প্রশাসনের স্ব বিবেচনা ভিত্তিক কার্যে নীতিগতভাবে কি পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত এবং কি উপায়ে।
  • প্রশাসনের কোন কার্য আদালতের পরীক্ষণ বহির্ভূত।
  • প্রশাসনের স্ব বিবেচনা প্রসূত কার্যক্ষমতা পুনঃনিরীক্ষণের যোগ্যতা কি পর্যন্ত বিস্তৃত।
  • প্রশাসনিক ন্যায়পীঠের কোন কোন নিয়মাবলী বিচারকার্যে অনুসরণ করা উচিত।
  • প্রশাসনের কার্যক্রম বা সিদ্ধান্ত সমূহের উদ্দেশ্যকে পরীক্ষা করার ক্ষেত্রে কোন পরিস্থিতি গুলো গৃহীত হওয়া যুক্তিসঙ্গত।
  • বিচার বিভাগ ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের উপায় কি।
  • প্রশাসনের মৌল ন্যায় আচরণের বিষয় ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে কোন পদ্ধতি অনুসৃত হবে।
  • ভর অর্পিত আইন প্রণয়নের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকির ক্ষেত্রে গৃহীত ব্যবস্থা গুলি কি এবং এগুলো নির্বাহ কার দায়িত্বে হবে।
  • প্রশাসনের বিপক্ষে তার ক্ষমতা অপব্যবহারের জন্য গৃহীতব্য প্রতিকার গুলো কি।
সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইন এর আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে উপরোক্ত বিতর্কিত প্রশ্ন গুলোর যথাযথ উত্তর খুঁজে বের করায় প্রশাসনিক আইনে বিবেচ্য বিষয়।অবশ্য বিশেষ সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে কোন সমস্যার যে সমাধান আইনানুগ হিসেবে গণ্য হয় তা অবস্থার ভিন্নতায় অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে বিধায় বিভিন্ন পদ্ধতি থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতা একেবারে উপেক্ষা করা উচিত হবে না।

প্রশাসনিক আইনের উৎস সমূহ

প্রশাসনিক আইন সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিম্নের উৎস বিভিন্নভাবে সমূহ কাজ করে-
  • কতিপয় প্রশাসনিক আইন রয়েছে যেগুলোর উৎস সরাসরি সংবিধান। যে সকল প্রশাসনিক ক্ষেত্রে পার্লামেন্টের প্রতিনিধিত্বের বিষয় বিজড়িত সে সকল ক্ষেত্রেই প্রশাসনিক আইনের জন্য সাংবিধানিক আইন অনুসৃত হওয়া আবশ্যক। এই ক্ষেত্রে সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইন যেন একই সূত্রে গাথা। প্রশাসনিক আইনের আওতাভুক্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন জেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠান, ইত্যাদির গঠনতন্ত্র ও কার্যাবলীর মূল উৎস স্থল হল সাংবিধানিক আইন।
  • পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত আইন ও কতিপয় প্রশাসনিক আইনের উৎস হিসেবে কাজ করে। পার্লামেন্ট এরূপ কতিপয় আইন প্রণয়ন করে থাকে, যেগুলোর বলে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা গঠিত হয় এবং এরা নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন ও পরিচালনা করার দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য থাকে। এ সকল দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা বা পদ্ধতি ও সংশ্লিষ্ট আইনে বর্ণিত থাকে।
  • প্রশাসনিক আইনের সেই অংশটুকু উৎস সে নিজে যা সংস্থা কর্তৃক সৃষ্টি আইন। অর্থাৎ এ সকল বিধি বা প্রবিধি সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিজস্ব সৃষ্টি। 
  • বিচারকের প্রদত্ত ব্যাখ্যা রয়েছে এরূপ বিচারালয় সৃষ্ট আইন অংশটুকুর উৎস একমাত্র বিচারালয়। অর্থাৎ কোন প্রশাসনিক সমস্যা যখন আদালতের সামনে উপস্থাপিত হয় সে ক্ষেত্রে আদালত যে রায় বা ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন পরবর্তীকালে তাই প্রশাসনিক আইন হিসেবে গণ্য হয়। এ অর্থে প্রশাসনিক আইনের একটি উৎস হলো বিচারালয়।
  • প্রচলিত রীতি বা প্রথা কে প্রশাসনিক আইনের আরেকটি উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। ইংল্যান্ডে এখনো আইন হলো আজযুগের প্রথা, যা বিধিবদ্ধ আইন নয় এবং বিচারকের সিদ্ধান্ত গৃহীত নীতি কমন ল বা প্রচলিত রীতির রেওয়াজ।
অবশ্য কালক্রমে ইংল্যান্ডের আইন বিধিবদ্ধ হতে থাকে এবং সে মতে দেশের বিচার অনুষ্ঠিত হতে থাকে। তবুও অনেক ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের সামাজিক জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান বিধিবদ্ধ রূপে পাওয়া যায় না। এমন বিস্তৃত ক্ষেত্রে কাঙ্খিত প্রতিকার জনগণ কমল্লা থেকে গ্রহণ করে।

সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইনের পার্থক্য

অধ্যাপক হল্যান্ড গণভিত্তিক আইনটি যে ছয়টি ভাগে বিভক্ত করেছেন তার মধ্যে প্রশাসনিক আইন কে দ্বিতীয়র স্থানে রেখেছেন। সে মতে সাংবিধানিক আইন গঠন অবয়ব ও কাঠামোর সাথে সংশ্লিষ্ট আর প্রশাসনিক আইন কার্যাবলীর সাথে সম্পৃক্ত। সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইন এর পার্থক্য সমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
  • প্রশাসনিক আইন সাংবিধানিক আইনসহ বিভিন্ন উৎস হতে আগত। পক্ষান্তরে, সংবিধানই সাংবিধানিক আইনের উৎস। কোন রাষ্ট্রের সংবিধান সংক্রান্ত আইনই উক্ত দেশের সাংবিধানিক আইন।
  • প্রশাসনিক আইন হলো আইনের এরূপ একটি শাখা যার মাধ্যমে প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের ক্ষমতাও কার্যাবলী সহ সরকারের সকল বিভাগসমূহ, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিধান প্রণীত থাকে। পক্ষান্তরে, সাংবিধানিক আইনের মাধ্যমে আইনের এরূপ একটি শাখার উন্মেষ ঘটেছে যা দিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গঠন এবং সরকারের বিভিন্ন অঙ্গসমূহ কে গঠন ও ক্ষমতাসমূহ এবং তাদের  মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয়।
  • প্রশাসনিক আইন কর্তৃক সরকারি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পক্ষান্তরে, সাংবিধানিক আইন দিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কাঠামো পরিচালিত হয়।
  • প্রশাসনিক আইনের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের কোন প্রকার সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয় না। পক্ষান্তরে, সাংবিধানিক আইন সাধারন নাগরিকদের পারস্পারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নীতি প্রণয়ন করে।
  • প্রশাসনিক আইনে জনগণের সাথে সরকারের সম্পর্ক স্থাপন করা হয় না। পক্ষান্তরে, সাংবিধানিক আইন জনগণের সাথে সরকারের সম্পর্ক স্থাপন করে।
  • প্রশাসনিক আইন সর্বদা সাংবিধানিক আইনের আওতাধীন থেকে স্বীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে।পক্ষান্তরে, সাংবিধানিক আইন সংবিধানের অধীন প্রশাসনিক আইনের নয়।
  • প্রশাসনিক আইনের মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকার বিবৃত হয় না। পক্ষান্তরে, সাংবিধানিক আইনে জনগণের মৌলিক অধিকার সমূহ কি তা ব্যাখ্যাত হয়।
  • প্রশাসনিক আইন তার সক্রিয় বিভাগ সমূহের কার্যক্রম বিবৃত করে। পক্ষান্তরে, সাংবিধানিক আইন সরকারের বিভিন্ন নিশ্চল শাখা সমূহের কার্যাবলীর ব্যাখ্যা দেয়।
  • প্রশাসনিক আইন সর্বদাই লিখিত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, সাংবিধানিক আইন লিখিত ও অলিখিত উভয় প্রকরণের হতে পারে।
  • সাংবিধানিক আইনের অর্পিত ক্ষমতা বলে প্রশাসনিক আইন প্রণীত হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে, সাংবিধানিক আইন দেশের সর্বোচ্চ আইন, অন্য কোন আইনের অবিভাজ্য অংশ নয়।

প্রশাসনিক সংস্থার আইন প্রণয়ন ক্ষমতা

কোন দেশের রাষ্ট্র প্রধানের যুদ্ধ ঘোষণা, শান্তি চুক্তি, সন্ধি স্থাপন ও সামরিক বিধি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অধ্যাদেশ জারীর বিশেষ ক্ষমতা আছে। এমন অনেকগুলো বিষয় রয়েছে যেগুলো সম্পর্কে আইন পরিষদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনে নিরিখের প্রশাসনের উপর বিধি, উপবিধি প্রণয়নের দায়িত্ব অর্পণ করতে পারে। এরূপ ক্ষমতা প্রদান সর্বতোভাবে কল্যাণকর না হলেও এবং এটা ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতির পরিপন্থী  হলেও প্রশাসনের কর্মচারীগণ বাস্তব কর্ম ক্ষেত্রে,
সাংবিধানিক-আইন-ও-প্রশাসনিক-আইন
সমাসীন থাকায় তারা স্থানীয় অবস্থার যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারার কারণে এবং পরিস্থিতির মূল্যায়নে প্রয়োজনে পদক্ষেপ গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত হওয়াই এরূপ আইন প্রণয়নের ক্ষমতা পেয়ে থাকেন। অধনা জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের সার্থক রূপায়ণের সুমহান লক্ষ্যে ত্বরিত আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়নবিধানের জন্য প্রশাসনের উপর প্রভূত দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। আইন পরিষদের গৃহীত আইন বিরথাযথ ভাবে দক্ষতার সাথে বলবধ করার দায়িত্বে নিয়োজিত প্রশাসনিক কর্মকর্তাগর নিয়ম-কানুন নিয়ন্ত্রণাদেশ  ও

উপবিধি প্রণয়নের ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। এটি ভারার্পিত আইন প্রণয়ন বিধি। সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইন এর আলোচনায় প্রফেসর ওয়েড এর মতে, প্রশাসনিক আইন প্রণয়ন এবং ভারার্পিত আইন প্রণয়নের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করা অত্যন্ত দুরূহ। লিখিত বা অলিখিত সকল আইন সম্পর্কে জনসাধারণের জ্ঞাত হওয়ার অধিকার রয়েছে বিধায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট সকল প্রশাসনিক বা ভারার্পিত আইন যথারীতি মুদ্রণ এবং প্রচারের নির্দেশ দেন।

মন্তব্যঃ সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইন

রাষ্ট্রের মৌলিক আইন সাংবিধানিক আইন এর মধ্যে নিহিত। এই আইনের মধ্যে সরকার প্রতিষ্ঠা এবং সার্বভৌম কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা চর্চা বা পরিচালনার নীতিমালার বর্ণনা থাকে। সার্বভৌম ক্ষমতার সংরক্ষণ কাদের মাধ্যমে করা হবে তা সাংবিধানিক আইনের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের কর্মতৎপরতার প্রণালী এই আইনের নির্দেশ থাকে।

অপরদিকে প্রশাসন শব্দটির সাথে শাসন, পরিচালন, প্রশাসন, অধিকারী, প্রশাসক, শাসক, পরিচালক ইত্যাদি শব্দ বলে প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। গণভিত্তিক আইনে রাষ্ট্র সরকার সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ব্যবস্থার সকল আইন কানুনকে প্রশাসনিক আইন হিসেবে চিহ্নিত করে। সাংবিধানিক আইন ও প্রশাসনিক আইন দুটি ভিন্ন হলেও এদের মধ্যে আন্তঃসংযোগ রয়েছে। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আমিন একটিভ নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url