অনুচ্ছেদ ৭০ দল ত্যাগ - ফ্লোর ক্রসিং সম্পর্কিত সাংবিধানিক বিধান
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ দল ত্যাগ সম্পর্কে বর্ণনা দেয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। সংসদ সদস্যরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেন স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পারেন সেটি গণতান্ত্রের চাহিদা। তবে বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদে প্রয়োগকৃত বিষয়টি,
এই মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হেয় করেছে। ৭০ নং অনুচ্ছেদের ক্ষমতা বলে একটি রাজনৈতিক দল তার অধীনে থাকা সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত বিবেককে কাজে লাগিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করেছে। আজ কের লেখনিতে ফ্লোর ক্রসিং সম্পর্কিত সাংবিধানিক বিধান নিয়ে আলোচনা করা হবে।পেজ সূচিপত্রঃ অনুচ্ছেদ ৭০ দল ত্যাগ
অনুচ্ছেদ ৭০ দল ত্যাগ
অনুচ্ছেদ ৭০ দল ত্যাগ নিয়ে আলোচনার সাথে সম্পর্কিত হলো গণতন্ত্র। গণতন্ত্র এমন
একটি শাসন ব্যবস্থা যেখানে জনগণ সকল ক্ষমতার মালিক। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়
প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, এবং ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগের
মত উপাদান সমূহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী কাঠামো হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
গণতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধ যখন দলীয় স্বার্থ ও শৃংখলার মুখোমুখি হয় তখনই জন্ম
নেয় এক গভীর সাংবিধানিক ও নৈতিক বিতর্ক। বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ এই
বিতর্কের একটি কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত।
সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ দলত্যাগ বা দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার উপর
নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অর্থাৎ সংসদ সদস্য যদি নিজ দল ত্যাগ করেন অথবা সিদ্ধান্তের
বিষয়ে নিজ দলের ভোট প্রদান করেন তাহলে তার আসন শূন্য হয় অর্থাৎ তার সদস্য পদ
বাতিল হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যেটি উঠে আসে সেটি হলো
নির্বাচিত প্রতিনিধির প্রথম দায় কি তার দল নাকি তার ভোটার। গণতান্ত্রিক
প্রতিষ্ঠানগুলো যখন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হন তখনই গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে
পড়ে।
দলত্যাগের সংজ্ঞা এবং দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোন সংসদ সদস্য যদি কোনো রাজনৈতিক দলের
প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে উক্ত রাজনৈতিক দল থেকে পদত্যাগ করে বা সেই দলের বিপক্ষে
ভোট প্রদান করে তাহলে তার আসন শুন্য হয়ে যাওয়ার এই প্রক্রিয়াকে দলত্যাগ বা
ফ্লোরক্রসিং (Floor Crossing) বলে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ৭০ নং
অনুচ্ছেদে দলত্যাগ একটি স্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ বিধান হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
খন্দকার দেলোয়ার হোসেন বনাম বাংলাদেশ, ২০০৯ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন,
আরও পড়ুনঃ নৃশংস হত্যার আইনসম্মত জবাব
সংসদ সদস্যরা শুধুমাত্র দলীয় পুতুল নন বরং তারা জনগণের প্রতিনিধি। কিন্তু
বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোয় তারা দলিয় সিদ্ধান্তের বাইরে কার্যত নির্বিকার।
সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত হলো অনুচ্ছেদ ৭০। অনেক সংবিধান
বিশেষজ্ঞ দলত্যাগের মাধ্যমে সংসদীয় স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে মনে করেন। এই
অনুচ্ছেদের কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর একচেটিয়া কর্তৃত্ব আরও দৃঢ় হয়। যখন
জনপ্রতিনিধি দলীয় বাধায় ভোট দিতে পারেন না তখন ভোটারদের আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষিত
হয়।
অনুচ্ছেদ ৭০ এর জন্মের প্রেক্ষাপট
ফ্লোর ক্রসিং একটি বিধান যেটি বিতর্কিত এবং গণতন্ত্রের কাঠামো বিরোধী। অনুচ্ছেদ
৭০ এর জন্ম বা উৎপত্তি হঠাৎ করেই হয়নি। এই অনুচ্ছেদ ৭০ এর জন্মের পেছনে রয়েছে
বাস্তব ও রাজনৈতিক ইতিহাস। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীনের প্রথম
বছরগুলোতে এর প্রেক্ষাপট জন্ম নেয়। দেশ স্বাধীনের পর যে কোন দেশেরই শক্তিশালী
সরকার এর প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই দেশেরও শক্তিশালী সংসদ
গঠনের প্রয়োজন পড়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সময়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সংসদ
সদস্যদের বিশৃঙ্খলা মনোভাব।
সংবিধান প্রণয়নকালে ১৯৭২ সালে দেখা যায় দলীয় শৃঙ্খলার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা
এবং সংসদ সদস্যদের মধ্যে দল ত্যাগের প্রবণতা। দলকে এবং রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল
অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য সংবিধান প্রণেতাগণ মনে করেন এমন একটি নিয়ম প্রয়োজন
যাতে সংসদ স্থিতিশীলতা অর্জন করে। এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই
প্রয়োজনের তাগিদেই ১৯৭২ সালে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৭০ এর বিধান সংযুক্ত করা হয়।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য অনুচ্ছেদ ৭০ কে তৎকালীন সময়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
মত প্রকাশে রাজনৈতিক নিপীড়ন
অনুচ্ছেদ ৭০ বাংলাদেশ সংসদীয় ব্যবস্থায় এমন একটি বিধান যেটি সংসদ সদস্যদের দলীয়
নির্দেশ বা হুইপ এর বাইরে গিয়ে মত প্রকাশ বা ভোট প্রদানের স্বাধীনতাকে
বাধাগ্রস্থ করে। অনুচ্ছেদ ৭০ এর একটি ফলাফল হল দলীয় চাপে আইন প্রণয়ন যেটি
গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের
মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করাই সংসদের মূল ভূমিকা। কিন্তু অনুচ্ছেদ ৭০ এর কারনে সংসদ
সদস্যগণ সংসদে উত্থাপিত কোন বিতর্কিত বিল এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারেন না। যার
ফলস্বরূপ জনস্বার্থ বিরোধী আইন পাস হয়।
গণতন্ত্রের আরো একটি ভিত্তি হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আত্মসমালোচনা থাকা।
অনুচ্ছেদ ৭০ এর কারণে সংসদের বিতর্ক ও পর্যালোচনা দুর্বল হয়ে পড়ে। এমনকি সংসদ
সদস্যদের স্বাধীন চিন্তা ও ভূমিকা আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ে। যে সংসদ প্রকৃত
স্বাধীনতা ও ক্ষমতা না রেখে শুধু সরকারের সিদ্ধান্ত ও নীতিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে
অনুমোদন দেয় তাকে রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্ট বলে। অনুচ্ছেদ ৭০ এর কারণে সংসদ
রাবার স্ট্যাম্প পার্লামেন্টে বা সিলমোহর সংসদে পরিণত হয়। গত কয়েক দশকে যে সব
আইন পাস হয়েছে,
যেমনঃ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, নির্বাচন কমিশন আইন এবং সংবিধান সংশোধন এর অধিকাংশই
সংসদে বিরোধিতা ছাড়াই পাস হয়েছে। দলীয় হুইপ অমান্য করলে আসন শুন্য হওয়ার ভয়
থেকেই এটি সংঘটিত হয়েছে। যে ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের সরকার পরিচালনায় সরকারের তিনটি
প্রধান অঙ্গ একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ পরিমিত রাখে সেই ব্যবস্থাকে চেক এন্ড ব্যালেন্স
বলে। সংসদের বিরোধিতা ছাড়া আইন পাস হলে চেক এন্ড ব্যালেন্স নষ্ট হয়। এবং এই
প্রক্রিয়া রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের কাঠামো দুর্বল করে। এর পাশাপাশি জনগণের
প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
গণতন্ত্রে ভিন্নমতের প্রয়োজনীয়তা
প্রতিটি মানুষের বা রাজনৈতিক দলের নিজস্ব মতামত বা সিদ্ধান্ত যা সরকার বা অন্যদের
থেকে আলাদা হতে পারে, একেই গণতন্ত্রের ভিন্নমত বলে। গণতন্ত্রের হৃদয় হল ভিন্নমত
প্রকাশের স্বাধীনতা। কার্যকর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সুসংহতভাবে পরিচালিত হওয়ার
মাধ্যম হল নীতি নির্ধারণ ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষদের
অংশগ্রহণ। অনুচ্ছেদ ৭০ এ বর্তমান সীমাবদ্ধতার জন্য বাংলাদেশের সংসদে ভিন্নমত
প্রকাশ অসম্ভব হয়ে পরেছে। গণতন্ত্র মানেই মতপার্থক্য এবং এই মতপার্থক্য থেকেই
দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার উৎপত্তি হয়।
রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজস্ব বিবেক এবং জনগণের স্বার্থ অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই
সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব। কিন্তু তারা যদি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে অবস্থান না
নিতে পারেন তাহলে সংসদীয় বিতর্ক অর্থহীন হয়ে যায়। ভিন্নমত শুধু বিরোধিতা নয় বরং
এটি বিকল্প সমাধান খুঁজে নেয়। জনস্বার্থ বিরোধী বিল পাসে বাধা দান এবং কোন
সংবিধান সংশোধনী নিয়ে সতর্কতা জাগানোর ক্ষেত্রে ভিন্নমতের গুরুত্ব অপরিসীম।
মিডিয়ার স্বাধীনতা, মানবাধিকারের রক্ষা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিরোধী দল ও
সরকারি দলের মধ্যকার ভারসাম্য রক্ষার জন্য ভিন্নমত খুবই প্রয়োজন।
আরও পড়ুনঃ গ্রাম আদালত আইন কি
ভিন্ন মত দমন করা হলে সেখানে গণতন্ত্র ধীরে ধীরে কর্তৃত্ববাদের রূপ নেওয়া শুরু
করে। গণতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে স্বৈরতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য একদলীয়
মনোভাবই যথেষ্ট। এটি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য খুবই ক্ষতিকর। গণতন্ত্রের
ভিন্নমত একটি নিরাপত্তা বলয়ের মতো যেটি সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের পথ রুদ্ধ করে।
কাজেই, অনুচ্ছেদ ৭০ দল ত্যাগের বিধানটি উপেক্ষা করে সংসদের স্বাধীন মত
প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা সময়ের দাবি।
দলীয় চাপে আইন প্রণয়ন
দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইন প্রণয়ন বর্তমানে বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে এখন
একটি সাধারন চিত্র। ফ্লোর ক্রসিং সম্পর্কিত সাংবিধানিক বিধান যা বাংলাদেশের
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে সেটি মূলত সংসদ সদস্যগণের স্বাধীনভাবে মতামত
প্রকাশ এবং ব্যক্তিগত বিবেচনার পথ রুদ্ধ করে দেয়। যার কারণে অধিকাংশ সময় দেখা
যায়, জনগণের সর্বোচ্চ কল্যাণে উপযোগী নয় এমন কোন আইন পাস হতে গেলেও দলীয় চাপে সকল
সংসদ সদস্যকে সেটির পক্ষে ভোট দিতে হয়। যার ফলে বাস্তব কিছু ক্ষতি হয় যেমন,
সংসদে গঠনমূলক বিতর্কের সুযোগ ধীরে ধীরে কমে যায় এবং জনগণের প্রকৃত মত প্রতিফলিত
হয় না। এর পাশাপাশি যে কোন আইন পাস হয় এক চেটিয়া ভাবে। বিরোধী দল কে দমন করতেও
অনেক সময় এমন দলীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবহৃত হয়। এর ফলস্বরূপ সংসদ হয়ে ওঠে একটি দলীয়
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কেন্দ্র যেখানে স্বাধীন চিন্তা ও বিবেকের জায়গা প্রায় থাকে
না। এমন দলীয় চাপে আইন প্রণয়ন গণতন্ত্রের মূল আত্মাকে আঘাত করে। এভাবেই অনুচ্ছেদ
৭০ দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখলেও জনস্বার্থ, আইনের মান এবং গণতান্ত্রিক ভারসাম্য
ক্ষতিগ্রস্থ করে।
স্বাধীন ভোটাধিকার এবং সাংবিধানিক বাধা
একজন সংসদ সদস্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক অধিকার হল গণতান্ত্রিক
ব্যবস্থায় ভোটাধিকার। ভোটাধিকার সংসদ সদস্যের রাজনৈতিক মতবাদ এবং জনগণের
প্রতিনিধিত্ব ও তার নৈতিক অবস্থান প্রকাশের একটি মাধ্যম। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ
তাদের এই স্বাধীনতা হরণ করেছে। অনুচ্ছেদ ৭০ এ বলা হয়েছে, কোনো সংসদ সদস্য যদি নিজ
দল ত্যাগ করেন বা সংসদে সেই দলের বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করেন তাহলে সংসদে তার আসন
শূন্য হবে। যার কারণে সদস্যগণ নিজেদের স্বাধীন মতপ্রকাশে আইনগত ভীতি অনুভব করেন।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশের দেওয়ানী মামলার মামলা পর্ব
অনুচ্ছেদ ৭০ গণতন্ত্রের মূল নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। সংসদ সদস্য শুধু তার দলের নয়
বরং তার নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধি। সংসদ সদস্যের দায়িত্ব হল শুধু দলের
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন নয় বরং জনগণের ইচ্ছা সংসদে তুলে ধরা। ২০১০ সালের এক
হাইকোর্ট রুলিং এ বলা হয়, সংসদ সদস্যগণের স্বাধীনভাবে যুক্তি উপস্থাপন ও মত
প্রকাশের সুযোগ থাকা উচিত, নতুবা এটি গণতন্ত্র নয় বরং দলতন্ত্র। এভাবেই সংসদ
সদস্যগণের স্বাধীন ভোটাধিকার না থাকলে এবং ভিন্ন মতের স্বাধীনতা না থাকলে সংসদ
একনায়কতান্ত্রিক আইন পাশের মঞ্চ হয়ে ওঠে।
ফ্লোর ক্রসিং এর আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত
দল পরিবর্তন করে ভিন্ন মত প্রদর্শন শুধুমাত্র বাংলাদেশের সমস্যা নয় বরং এটি
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে পরিচিত। পাশের রাষ্ট্র ভারতের সংবিধানে
দলবদল রোধে ৫২ তম সংশোধনী যোগ করা হয়। এবং এই সংশোধনীতে দলত্যাগ বিরোধী আইন বা
Anti-Defection Law অন্তর্ভুক্ত হয়। যেটি বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ এর
অনুরূপ। অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার মতো দেশে ফ্লোর ক্রসিং অবাধ। তারা বাংলাদেশ বা
ভারত এর মত মতাদর্শের অনুসরণ করে না।
তাদের মতে একজন সংসদ সদস্য জনগণের প্রতিনিধি। কাজেই দল ত্যাগ করলে সদস্য পদ সেই
দেশের সংসদ সদস্যগণ হারান না। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায়, দলীয়
অনুগত্য ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্য অবশ্যই থাকা উচিত। তবে বাংলাদেশের
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ এ উল্লিখিত দলত্যাগ কে কঠোরভাবে দমন করে। যার কারণে সংসদে
মত প্রকাশের বাধাগ্রস্ত হয়। অথচ আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত থেকে প্রতীয়মান হয় যে
কিছু কিছু নমনীয়তা গণতন্ত্রকে আরব প্রাণবন্ত করে তোলে।
অনুচ্ছেদ ৭০ সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ দেশের রাজনীতিতে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য
গুরুত্বপূর্ণ হলেও এটি গণতন্ত্রের অন্যতম মূল ভিত্তি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও
ভিন্নমতের চর্চাকে ব্যাহত করছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের মতের
বৈচিত্র ও বিতর্ক রাজনীতির প্রাণ। ফ্লোর ক্রসিং কোন সংসদ সদস্যকে দলীয় সিদ্ধান্ত
থেকে ভিন্ন পথে চলার সুযোগ দেয় না। ফ্লোর ক্রসিং একনায়কতান্ত্রিক দলীয়তা তৈরি
করে যা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি প্রতীয়মান হয় যে,
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুনির্দিষ্ট সীমার মধ্যে দল ত্যাগ বিরোধী আইন রয়েছে।
কাজেই বাংলাদেশের সংবিধানেও অনুচ্ছেদ ৭০ নমনীয় করে সংশোধন করা প্রয়োজন যাতে
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকার পাশাপাশি সংসদের ব্যাক্তি স্বাধীনতাও রক্ষা
পায়। এ সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে উল্লেখ করা যায় এমন উপায় সমূহ হলোঃ
- শুধুমাত্র সরকার পতনের মত সংকটপূর্ণ বিষয়ের দলীয় হুইপ বাধ্যতামূলক করা।
- স্পিকার এর পরিবর্তে নিরপেক্ষ ট্রাইবুনাল দ্বারা সদস্যপদ বাতিলদের সিদ্ধান্ত প্রদান করা।
- অন্যান্য সাধারণ বিষয়ে সংসদ সদস্যগণের স্বাধীনভাবে ভোট প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করা।
মন্তব্যঃ অনুচ্ছেদ ৭০ দল ত্যাগ
অনুচ্ছেদ ৭০ দল ত্যাগ আমাদের সংবিধানের দলের শৃঙ্খলা রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ
হাতিয়ার হলেও আজকের বাস্তবতায় এটি গণতান্ত্রিক নীতিমালার সাথে বিরোধ সৃষ্টি
করেছে। সংসদ সদস্যদের স্বাধীন ভোটাধিকার, ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার এবং জনগণের
পক্ষে কথা বলার স্বাধীনতা গণতন্ত্রের প্রাণ। অথচ অনুচ্ছেদ ৭০ এর সীমাবদ্ধতা এসব
মৌলিক গুণাবলী কে বাধাগ্রস্থ করে। বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ফ্লোর
ক্রসিং এর কিছু নির্ধারিত সীমা থাকলেও তা কখনোই সংসদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা
পুরোপুরি কেড়ে নেয় না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখন সময় এসেছে এই অনুচ্ছেদটি পুনর্বিবেচনার যাতে করে
সংসদ সদস্যরা দলীয় আনুগত্য বজায় রেখে অন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে পারেন ঠিক
যেভাবে একটি সজীব গণতন্ত্রে হওয়া উচিত। ফ্লোর ক্রসিং সম্পর্কিত সাংবিধানিক
বিধান পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয় যে অনুচ্ছেদ ৭০ পরিবর্তন সময়ের দাবি। কেননা
ভিন্নমত গণতন্ত্রের অক্সিজেন আর অনুচ্ছেদ ৭০ যেন সেই অক্সিজেনের পথ রুদ্ধ করা এক
নিষ্পেষণ। গভীরভাবে বিশ্লেষিত এমন আইনি কনটেন্ট পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।
আমিন একটিভ নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url