গোপালগঞ্জ সংঘর্ষের আইনি বিশ্লেষণ - নাগরিক অধিকার বনাম রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা
বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয়
নিরাপত্তার মাঝে যে সম্পর্ক বিদ্যমান সেটি একটি অতি সংবেদনশীল বিষয়ে
রুপ লাভ করেছে। সাম্প্রতিক গোপালগঞ্জ জেলায় সংঘর্ষের যে ঘটনা ঘটেছে সেটি এই
দ্বন্দ্বকে আবারও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে।
যেখানে একদিকে রয়েছে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এবং মত প্রকাশের অধিকার, অন্যদিকে
রয়েছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব। আজকের
আর্টিকেলে আপনাদেরকে গোপালগঞ্জ সংঘর্ষের আইনি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংবিধানের আলোকে
জানিয়ে দেব নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ভারসাম্য বিষয়টি।
পেজ সূচিপত্রঃ গোপালগঞ্জ সংঘর্ষের আইনি বিশ্লেষণ
- গোপালগঞ্জ সংঘর্ষের আইনি বিশ্লেষণ
- সাংবিধানিক অধিকার ও নিরাপত্তা
- ১৪৪ ধারা জারি করার যৌক্তিকতা
- আইন অনুযায়ী অবৈধ সমাবেশ
- শান্তিপূর্ণ সমাবেশের আইনি অধিকার
- গোপালগঞ্জের বিক্ষোভে বল প্রয়োগের সীমা
- আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব
- নাগরিক স্বাধীনতার বাস্তব চিত্র
- দেশের নিরাপত্তার অপব্যবহার প্রসঙ্গে
- মন্তব্যঃ গোপালগঞ্জ সংঘর্ষের আইনি বিশ্লেষণ
গোপালগঞ্জ সংঘর্ষের আইনি বিশ্লেষণ
নাগরিক অধিকার ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা সময়ের সাথে
একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে এসেছে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে। জনগণের
মৌলিক অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এবং এর পাশাপাশি
রাষ্ট্রকে তার সার্বভৌমত্ব ও আইনশৃঙ্খলা এবং জাতীয় নিরাপত্তা বজায় রাখতে
হয়। এই কারণে অনেক সময় নাগরিকদের অধিকার ও স্বাধীনতার সাথেও সংঘর্ষ সৃষ্টি
হয়। সাম্প্রতিক গোপালগঞ্জে যে সংঘর্ষ ঘটেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনিক
পদক্ষেপের আলোকে এই দ্বন্দ আবারও দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোচনার কেন্দ্রে এসে
দাঁড়িয়েছে।
আজকের আর্টিকেলে আমরা সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া গোপালগঞ্জ সংঘর্ষের আইনি বিশ্লেষণের
মাধ্যমে এই ঘটনার সংবিধানের ধারাগুলো কিভাবে প্রযোজ্য হয়েছে এবং নাগরিক অধিকার ও
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছে কিনা তা যাচাই
করব। তার পাশাপাশি আমরা এটি দেখব সংঘর্ষে ঘটে
যাওয়া বিষয়গুলির বিচার কি হবে এবং রাষ্ট্র এবং আদালত এর কি পদক্ষেপ
গ্রহণ করবে অথবা তাদের করণীয় কি। চলুন আইনি বিশ্লেষণের মাধ্যমে সাম্প্রতিক ঘটে
যাওয়া এই ঘটনাটির আদ্যোপান্ত সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
সাংবিধানিক অধিকার ও নিরাপত্তা
ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও সমাবেশের অধিকার এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার হলো
বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানে এই মৌলিক অধিকার
সংরক্ষিত রয়েছে। তবে এই মৌলিক অধিকার সমূহ সীমাহীন নয় বরং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার
জন্য কিছু বিধি নিষেধ সরকার কর্তৃক আরোপ করা যেতে পারে। গণপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশের সংবিধান এর ৩৭ এবং ৩৯ নং অনুচ্ছেদে যথাক্রমে সমাবেশের স্বাধীনতা এবং
চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটি
মানুষের মৌলিক অধিকার।
তবে এই অধিকার এমন পর্যায়ে গড়াতে পারবে না যেটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য
হুমকি হয় অথবা স্বাধীনতা এমন হতে পারবে না যেটি অন্যের বিশ্বাসের অনুভূতিকে আঘাত
দেয়। বাংলাদেশের আদালত ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যেসব আইন সমূহ প্রণীত আছে
সেগুলো নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও রাষ্ট্রে নিরাপত্তার ভারসাম্য বজায় রাখে।
ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৪ নং ধারায় এমন একটি উদাহরণ পাওয়া যায়। উক্ত ধারা
অনুসারে কোন স্থানে যদি শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা থাকে তাহলে চারজনের
অধিক একত্রে থাকা নিষিদ্ধ।
গোপালগঞ্জে চলমান বিষয়টি এমন যে একটি দল সমাবেশ করছিল ওপর একটি দল এসে সেই
সমাবেশে বাধা প্রদান করে অবৈধভাবে। সমাবেশ করার অধিকার মৌলিক অধিকার। কাজেই যেই
দল সমাবেশ করছিল তারা তাদের অবস্থান থেকে সঠিক ছিল। কিন্তু যেই দল হঠাৎ আক্রমণ
চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৪ নং ধারা প্রযোজ্য। কারণ তাদের
দ্বারা সংঘটিত কাজটি দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ঠেলে দেয়।
১৪৪ ধারা জারি করার যৌক্তিকতা
ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ১৪৪ এ প্রশাসনকে এই ক্ষমতা দেয় যে যদি কোন এলাকায় কোন
অনিয়ম পরিস্থিতি দেখা যায় যা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থানীয় শান্তি-শৃঙ্খলা
রক্ষার বিঘ্ন ঘটে তাহলে সেই এলাকায় একত্রে চারজন চলাফেরা নিষিদ্ধ করতে পারবে।
এখানে উল্লেখ্য যে ১৪৪ ধারা শুধুমাত্র এই ধরনের বিশেষ পরিস্থিতির ক্ষেত্রেই
প্রয়োগ যোগ্য। এর ব্যাতিক্রম হলে সেটি মৌলিক অধিকারকে ক্ষুন্ন করতে পারে। অর্থাৎ
যখনই কোন এলাকা অনিয়ম ও বিশৃংখলার পরিবেশ হিসেবে প্রতীয়মান হয়, নির্বাহী
ম্যাজিস্ট্রেট ১৪৪ ধারা জারি করতে পারেন।
তবে এই ১৪৪ ধারা জারি করার সময় কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রশাসনকে
প্রয়োজনের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে। অর্থাৎ যতটুকু শান্তি শৃঙ্খলা
রক্ষার জন্য প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই করতে হবে। এই ধারা প্রয়োগ করার সময় নাগরিক
অধিকার যাতে হরণ না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ১৪৪ ধারা জারি করার সময়
নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নোটিশ প্রদান করতে হবে যাতে করে সবাই এই বিষয় সম্পর্কে অবগত
হতে পারে। এবং সর্বোপরি বিষয় হল ১৪৪ ধারা যতটুকু সময়ের জন্য প্রয়োগ করা
প্রয়োজন ততটুকু সময় পর্যন্ত প্রয়োগ করতে হবে।
আইন অনুযায়ী অবৈধ সমাবেশ
আইনশৃঙ্খলা বা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে এবং যার উদ্দেশ্য হলো
সহিংসতা এবং উস্কানি মূলক কার্যক্রম চালানো এমন একটি জনসমাগমকে অবৈধ সমাবেশ বলে।
বাংলাদেশ দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ১৪১ নং ধারা অনুযায়ী পাঁচ বা ততোধিক ব্যক্তির সমাবেশ
কে বেআইনি সমাবেশ বলা হয় যদি উক্ত সমাবেশ গঠনকারী ব্যক্তিদের সাধারণ উদ্দেশ্যঃ
- অপরাধ মূলক বল প্রয়োগ বা অপরাধমূলক বল প্রয়োগের হুমকি প্রদান করে সরকার কিংবা আইন পরিষদ বা কোন সরকারি কর্মচারীকে অনুরূপ সরকারি কর্মচারী হিসেবে তার আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শন করা।
- কোন আইন বা আইনগত ব্যবস্থা বাস্তবায়নে বাধা দেওয়া।
- কোন দুষ্কর্ম বা অপরাধমূলক অনধিকার প্রবেশ বা অন্য বিধ অপরাধ সংগঠন করা।
- কোন ব্যক্তির প্রতি অপরাধমূলক বল প্রয়োগ বা অপরাধ মূলক বল প্রয়োগের হুমকি দিয়ে কোন সম্পত্তি অধিকার বা অর্জন করা অথবা কোন ব্যক্তিকে রাস্তার অধিকার বা পানির ব্যবহার বা তদীয় দখল বা অধিকারভুক্ত অন্য কোন অশরীরী অধিকার হতে বঞ্চিত করা।
- অপরাধমূলক বল প্রয়োগ বা অপরাধ মূলক বল প্রয়োগের হুমকি দিয়ে কোন ব্যক্তিকে যা সম্পাদন করার জন্য সে আইনত বাধ্য নয় তা করতে বাধ্য করা বা যা সম্পাদন করার জন্য তার আইনসম্মত অধিকার রয়েছে তা সম্পাদন থেকে তাকে বিরত করা।
শান্তিপূর্ণ সমাবেশের আইনি অধিকার
নাগরিক অধিকার বনাম রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রসঙ্গে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের আইনি
অধিকারটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭ নং
অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত
যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত
হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।
এটি একটি মৌলিক অধিকার যা সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার
এক উপাদান হলো শান্তিপূর্ণ সমাবেশ।
আরও পড়ুনঃ
বাংলাদেশের দেওয়ানী মামলার মামলা পর্ব
শান্তিপূর্ণ সমাবেশ শুধুমাত্র নিজস্ব মত প্রকাশের মাধ্যম নয় বরং এটি রাষ্ট্রের
ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার একটি উপায়। আন্তর্জাতিক
মানবাধিকার চুক্তি এবং বাংলাদেশের ফৌজদারি আইনে সমাবেশের অধিকার রয়েছে।
International Covenant on Civil and Political Rights এর ২১ ধারায় বলা হয়েছে,
শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার সকলের থাকবে এবং তা শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক সমাজেই
অপরিহার্য পরিস্থিতিতে সীমাবদ্ধ থাকবে। বাংলাদেশ এর সদস্য হওয়ায় এই বিধিটি
রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের উপর বর্তায়।
গোপালগঞ্জ সংঘর্ষের আইনি বিশ্লেষণ এ দেখা যায় যে দলটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ এর
আয়োজন করেছিল তারা সাংবিধানিক দিক থেকে সঠিক ছিল, বিধিবদ্ধ আইনের দিক থেকেও সঠিক
ছিল এমনকি আন্তর্জাতিক আইন অনুসারেও সঠিক ছিল। এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের আয়োজন
করাটি তাদের মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭
নং অনুচ্ছেদে তারা এই বিষয়টির বৈধতা প্রাপ্ত হয়েছে।
গোপালগঞ্জের বিক্ষোভে বল প্রয়োগের সীমা
বিক্ষোভ সমাবেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে এই বিক্ষোভ
সহিংসতার পর্যায়ে চলে যায় যার ফলস্বরূপ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বল প্রয়োগের
মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। ফৌজদারী কার্যবিধি এবং Police
Regulations of Bengal, 1943 এর আলোকে পুলিশ বা প্রশাসন বল প্রয়োগ করতে
পারে তবে তা হতে হবেঃ
- ন্যূনতম প্রয়োজনীয় মাত্রায় অর্থাৎ যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু বল প্রয়োগ করতে পারবে।
- সমানুপাতিক বল প্রয়োগ করবেন।
- অসামরিক ব্যক্তিদের জীবন ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন।
- বিক্ষোভে বল প্রয়োগ হবে সর্বশেষ বিকল্প।
- বিক্ষোভে একান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া প্রাণঘাতই বল প্রয়োগ করা যাবে না।
- বিক্ষোভের প্রতিটি বল প্রয়োগের ঘটনায় ন্যায় বিচারমূলক তদন্ত হওয়া আবশ্যক।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ২৭,৩১ ও ৩২ নং অনুচ্ছেদে যথাক্রমে আইনের
দৃষ্টিতে সমতা, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, জীবন ও ব্যক্তির স্বাধীনতার অধিকার
রক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ সমূহ বাস্তবায়নের জন্য আইন-শৃঙ্খলা
বাহিনীর মূল দায়িত্ব হলো, নাগরিকের জীবন ও সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার
পাশাপাশি আইনের প্রয়োগে পক্ষপাতহীনতা বজায় রাখা। এবং অপরাধ ও নিয়ন্ত্রণ করা।
এছাড়াও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ করা। একটি রাষ্ট্রের সার্বিক
স্থিতিশীলতা নিরাপত্তা,
আরও পড়ুনঃ
গ্রাম আদালত আইন কি
এবং নাগরিক অধিকার রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা অপরিহার্য। বাংলাদেশ পুলিশ
এবং অন্যান্য বাহিনী পরিচালিত হয় একাধিক আইনের অধীনে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো
পুলিশ আইন ১৯৮১, ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮, Police Regulations of Bengal 1943। এই
আইন সমূহ তে বলা হয়েছে কোন বাহিনীর যদি বল প্রয়োগ করে তাহলে তা সংযম যুক্তি ও
প্রয়োজনের ভিত্তিতে হতে হবে। জনগণের সাথে আচরণে ভদ্রতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে
হবে। আইনি অনুমতি ও ব্যতীত গৃহে প্রবেশ বা গ্রেপ্তার কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে
না।
নাগরিক স্বাধীনতার বাস্তব চিত্র
নাগরিক অধিকার বনাম রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পর্যালোচনা করলে নাগরিক স্বাধীনতার
বাস্তব চিত্র সম্পর্কে আলোচনা করা জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। নাগরিক স্বাধীনতা
একটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক নৈতিকতার প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্র কতটা মানবিক এবং কতটা
গণতান্ত্রিক সেটি নির্ভর করে না সংবিধানে কি লিখিত রয়েছে। বরং এটি নির্ভর করে
সংবিধানের লিখিত বিধানগুলি বাস্তবে কতটুকু প্রয়োগ করা হচ্ছে সেটির উপর।
সংবিধানের ২৭, ৩২, ৩৭, ৩৯ ও ৪১ অনুচ্ছেদ সমূহতে যথাক্রমে বর্ণিত হয়েছে আইনের
দৃষ্টিতে সমতা,
ব্যক্তি স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার, মত প্রকাশের
স্বাধীনতা ও চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার বিষয় সমূহ। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো
অনেক সময় সামাজিক মাধ্যমে সরকারের সমালোচনা করলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের
আওতায় গ্রেফতার করা হয়। নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমাবেশে বারবার অনুমতির না
দেওয়া, ১৪৪ ধারা জারি করে তা বন্ধ করা অথবা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে পুলিশি বল
প্রয়োগ এর মত বিষয়গুলো। ক্ষমতাসীন দলের সমাবেশ বা কর্মকান্ডে প্রশাসনের
নমনীয়তা অথচ বিরোধী দলের প্রতি কঠোরতা।
এই ধরনের দ্বিমুখী আচরণ সংবিধানের উল্লিখিত অনুচ্ছেদ সমূহ কে বাস্তবায়ন বাধা
প্রদান করে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংবিধানে মৌলিক অধিকার এর মধ্যে উক্ত
বিষয়গুলো যদিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কিন্তু বাস্তবিকভাবে সেই প্রয়োগ গুলোর
দিকে নজর দেওয়া হলে দেখা যায় নাগরিক স্বাধীনতার বাস্তব কোন প্রয়োগ নেই। কাজেই
বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে এই দ্বিমুখী আচরণ
পরিত্যাগ করতে হবে। এবং সংবিধানকে গুরুত্ব দিয়ে সাংবিধানিক আইন প্রতিষ্ঠা করতে
হবে।
দেশের নিরাপত্তার অপব্যবহার প্রসঙ্গে
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা একটি দেশের সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশীলতা এবং নাগরিকদের সার্বিক
কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে বাস্তবতা হলো অনেক
সময় এই নিরাপত্তা শব্দটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নাগরিকের অধিকার খর্ব করা
হয়, ভিন্নমত দমন করা হয় এবং গণতন্ত্রের গলা চেপে ধরা হয়। যেভাবে রাষ্ট্রীয়
নিরাপত্তার অপব্যবহার হয় তা নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
- ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারা জারি করে রাজনৈতিক শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে।
- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে মত প্রকাশের অধিকার দমন করে।
- বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা দায়ের করার মাধ্যমে।
- ঘুম, গ্রেফতার, ভয় ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে দমন করার মাধ্যমে।
- গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের উপর নজরদারি ও হয়রানি করার মাধ্যমে।
মন্তব্যঃ গোপালগঞ্জ সংঘর্ষের আইনি বিশ্লেষণ
গোপালগঞ্জ সংঘর্ষের আইনি বিশ্লেষণ করে এটি প্রতীয়মান হয় যে রাজনৈতিক মত প্রকাশের
অধিকার ও আইনের রক্ষাকবচ কার্যকর ভূমিকা রাখছে কিনা সেই প্রশ্ন। নাগরিক
অধিকার বনাম রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রসঙ্গে এই বিষয়টি উত্থাপিত হয় রাষ্ট্র একটি
রাজনৈতিক দলের নিরাপত্তা দিতে কতটা তৎপর। এবং রাষ্ট্রের ভূমিকা এই বিষয় সমূহতে
কতটুকু রয়েছে। পাঠকগণের নিকট আজকের আর্টিকেলে গোপালগঞ্জে সংঘর্ষের বিষয়টি
সম্পর্কে আইনি বিশ্লেষণ করে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
যেহেতু বিষয়টি সাম্প্রতিক ঘটেছে এবং এখানে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত মৌলিক অধিকার
লঙ্ঘিত হওয়ার মতো বিষয় ঘটেছে তাই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের জানা
জরুরী আইন এই ব্যাপারে কি বলে। কেননা একটি মানুষ যখন আইন সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান
রাখবে তখনই তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে। রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত না
হলেও অন্তত এটি জেনে রাখা জরুরী কোথায় একটি ব্যক্তির কোন কোন অধিকার সমূহ
রয়েছে। আইন সম্পর্কিত এমন গবেষণামূলক তথ্য পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।
আমিন একটিভ নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url